চাকরির ভাইভা বোর্ডে অপদস্থ হচ্ছেন মাদরাসা শিক্ষার্থী ও হিজাবি মেয়েরা

লিখেছেন লিখেছেন এমএ হাসান ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৭:৫১:৩১ সকাল

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর

গড়িয়েছে। আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পাবলিক

সার্ভিস কমিশনে এনবিআরের ‘রাজস্ব

কর্মকর্তা’ পদের ভাইভা পরীক্ষা চলছে। রুমের

বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন চাকরি প্রার্থীরা।

একে একে ভেতরে যাচ্ছেন

এবং ভাইভা শেষে ফিরে আসছেন। হঠাত্ কান

খাড়া করলেন বাইরের পরীক্ষার্থীরা। ভেতর

থেকে ধমকের আওয়াজ আসছে! কেউ

কাউকে আচ্ছামতো শাসাচ্ছে। মিনিট দশেক

পরে বের হয়ে এলেন এক মহিলা চাকরি প্রার্থী।

হিজাব পরা মেয়েটির মুখ ঢাকা ছিল নিকাবে।

তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, তার চোখ ছলছল

করছে। সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমাণ পরীক্ষার্থীদের

মধ্য থেকে তার দিকে এগিয়ে গেলেন সিরিয়ালের

তার পরেই থাকা থানভীরসহ কয়েকজন।

‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করতে মেয়েটি শুধু

বলেছিলেন, ‘তেমন কিছু নয়। হিজাব নিয়ে একটু

বকাবকি করেছে।’ পরীক্ষা দিতে আসা তার এক

সহপাঠী জানান, ওই

মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান

বিভাগের ২০০৫-০৬ সেশনের ছাত্রী।

তিনি মাদরাসায় না পড়লেও সব সময়

ক্যাম্পাসে হিজাব পরতেন। ঘটনার ক’দিন পর

তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়,

কিছুটা মেজাজি ধরনের ওই মেয়ে সেদিন

ভাইভা বোর্ডের এক পরীক্ষক কর্তৃক হিজাব

নিয়ে কটাক্ষ করার প্রতিবাদ করেন।

এতে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় (গালাগালি পর্যায়ের)

বকাঝকা করা হয়। পরে তিনি রাগ করেই বোর্ড

থেকে উঠে চলে আসেন।

মেয়েটি বের হওয়ার পরই ভাইভা বোর্ডের

সামনে হাজির হওয়ার পালা তানভীরের।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ

বিভাগের ২০০৭-০৮ সেশনের শিক্ষার্থী।

এনবিআরের ‘রাজস্ব কর্মকর্তা’ পদের জন্য

নির্বাচনী ও লিখিত পরীক্ষায় ভালোভাবেই

উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন ভাইভা দিতে।

তানভীর ভাইভা কক্ষে ঢুকলেন মাত্র।

অমনি চারজন পরীক্ষকের একজনের ব্যঙ্গাত্মক

সম্বোধন, ‘আপনি হিজাব পরে আসেননি?’ ওই

পরীক্ষকের নাম জহুরুল আলম এনডিসি।

তিনি পিএসসির সদস্য। জহুরুলের

প্রশ্নে তানভীর কিছুটা থতমত খেলেও

সামনে এগিয়ে গিয়ে স্মিত হাস্যে বলেন, ‘স্যার,

হিজাব তো মেয়েদের জন্য। আমি সেটা পরব

কেন, স্যার?’ পরীক্ষক ‘তাই নাকি! ঠিক

আছে বসেন।’ বলে একটু দম নিলেন। তারপর

তানভীরের সঙ্গে স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গিতে কিছু

প্রাথমিক প্রশ্নোত্তর বিনিময়ের পর

সার্টিফিকেটের ফাইল হাতে নিলেন।

সার্টিফিকেট দেখার পরই জহুরুলের

চেহারা আবারও পরিবর্তিত হয়ে গেল। এরপর

একের পর এক প্রশ্ন— ‘এই তুমি কি মাদরাসার

ছাত্র?’ ‘মাদরাসায় পড়েছ কেন?’ ‘বাড়ির

আশপাশে কি কোনো স্কুল ছিল না?’

‘তোমার তো হেফাজত করার কথা!’

‘এখানে ভাইভা দিতে এসছ কেন?’

‘বলো তো হেফাজত সম্পর্কে কী জান?’

‘আচ্ছা, হিজাব পরতে হবে কেন?’

এভাবে উল্টোপাল্টা প্রশ্নের এক

পর্যায়ে জহুরুল আলম

এনডিসি তাকে আসতে বললেন। তানভীর এ

প্রতিবেদকের সঙ্গে তার এই

দুটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন গত বৃহস্পতিবার।

বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘মাদরাসা থেকে আসা’দের

জায়গা নেই

এটি মাত্র দু’সপ্তাহ আগের ঘটনা। ডিসেম্বরের

৮ তারিখ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘এডিশনাল

ডিরেক্টর’ (এডি)

পদে ভাইভা দিতে গিয়ে পরীক্ষকদের

কাছে অপদস্থ হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের

লোকপ্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তর এক

শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ও

চাকরিপ্রার্থী জানান, তার ভাইভা বোর্ডের

প্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের

ডেপুটি গভর্নর এসকে শুর।

চারটি বোর্ডে আলাদাভাবে এ ব্যাংকের

ভাইভা নেয়া হয়। এসকে শুরের বোর্ডে হাজির

হওয়ার পর মাদরাসা থেকে দাখিল-আলিম পাস

করা সার্টিফিকেট দেখে ‘র’ আদ্যক্ষরের ওই

পরীক্ষার্থীকে নানাভাবে প্রশ্ন

করে এবং হাসাহাসি করে অপমান করা হয়।

দেশে এত স্কুল রেখে কেন তিনি মাদরাসায়

পড়তে গেলেন, সে প্রশ্নও করা হয় তাকে।

ভবিষ্যতে ‘সুদি’ ব্যাংকে চাকরির আবেদন

না করার জন্যও বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের

এই পরীক্ষার ভাইভা এখনও চলমান।

বিসিএসের ভাইভায়ও একই অবস্থা

একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানালেন

মাদরাসা থেকে দাখিল-আলিম পাস

করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই

শিক্ষার্থী আরবি বিভাগ থেকে ২০১১-১২

সেশনে মাস্টার্স পাস করেছেন। ৩৩তম

বিসিএসে তিনি ‘শিক্ষক’ ক্যাডারে চাকরিও

পেয়েছেন। যদিও তার দাবি, তাকে ভাইভায়

যথাযথ নম্বর দেয়া হয়নি। অন্যথায় আরও

ভালো ‘ক্যাডার’ পেতেন তিনি। এই বিসিএস

ক্যাডার জানান, গত আগস্ট মাসে ভাইভায়

তাকে পরীক্ষকরা নাজেহাল করেন।

আগে মাদারাসায়

এবং পরে ঢাবিতে আরবি বিভাগে পড়েছেন

বলে তাকে কোনো মাদরাসা শিক্ষক হওয়ার

পরামর্শ দেন পরীক্ষকরা। চাকরির ক্ষেত্রে ওই

পরীক্ষার্থীর পছন্দ তালিকার

সর্বশেষে থাকা ‘শিক্ষক’ ক্যাডারই

তাকে দেয়া হয়। ৩৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ-

অনুত্তীর্ণ আরও বেশ কয়েকজন

মাদরাসা শিক্ষার্থী একই ধরনের অভিযোগ

করেছেন এ প্রতিবেদকের কাছে।

সমবায় অধিদফতরের অভিজ্ঞতা

সমবায় অধিদফতরের ‘সহকারী পরিদর্শক’ পদের

ভাইভা ছিল গত ৪ মে, ২০১৩।

পরীক্ষার্থী ‘জ’ (প্রকৃত নামের অদ্যক্ষর)

হাজির হয়েছেন বোর্ডের সামনে।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান

বিভাগ থেকে ২০১২-১৩ সেশনে মাস্টার্স পাস

করেছেন। বোর্ডে হাজির হওয়ার পর তার

সঙ্গে পরীক্ষকদের আচরণ ছিল বেশ স্বাভাবিক।

প্রাথমিক প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে এবার

সার্টিফিকেট দেখার পালা। প্রথমেই বের

হলো দাখিল পাসের সার্টিফিকেট। আর তাতেই

পরীক্ষক যেন পুরোপুরি ‘আশ্চর্য’ হয়ে গেলেন।

‘এত স্মার্ট একটা ছেলে মাদরাসায় পড়েছে!’

কাউকে উদ্দেশ না করেই বললেন তিনি। এরপর

বাকি সার্টিফিকেটগুলো আর খুলে দেখার ‘রুচি’

হয়নি পরীক্ষকের। তিনি মুখেই প্রশ্ন করা শুরু

করলেন পরীক্ষার্থীকে, ‘তুমি আলিমও পাস

করেছিলে?’ ‘জ্বী স্যার’ পরীক্ষার্থীর উত্তর।

‘ফাজিল-কামিলও পড়েছ?’ এবার পরীক্ষকের

কণ্ঠে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুর। ‘না স্যার। এরপর

তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।’ ‘কেন,

তুমি ফাজিল-কামিল পড়লে না কেন? পড়লে খুব

ভালো করতে!’

এরপর শুরু হলো হেফাজত আর জামায়াত-শিবির

নিয়ে নানা প্রশ্ন। ‘তুমি কি শিবির

করতে কখনও?’ ‘হেফাজতের ১৩

দফা সম্পর্কে তোমার মতামত কী?’ প্রশ্নের

একপর্যায়ে পাশে বসা আরেক পরীক্ষক তাকালেন

‘জ’-এর দিকে। মুখে তার মুচকি হাসি। নিজের

দুই গাল ক্লিন শেভড হলেও দাড়ি খিলাল করার

ভঙ্গিতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘মাদরাসার

ছাত্র! তোমরা দাড়ি কই, বাবা?’ এই

পরীক্ষকের এমন ব্যঙ্গাত্মক

অঙ্গভঙ্গিতে উপস্থিত এক মহিলাসহ চার

পরীক্ষক হো হো করে হেসে দিলেন। খানিক

পরে ‘জ’কে দাড়ি রাখার পরামর্শ দিয়ে বিদায়

করা হয়। বলা বাহুল্য, এই চাকরি হয়নি ‘জ’-

এর।

ঘটনা শুধু এই চারটিই নয়

গত প্রায় তিন বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের

শতাধিক বন্ধু, বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের কাছ

থেকে ‘মাদরাসা থেকে দাখিল অথবা আলিম পাস

করার’ কারণে তারা চাকরিসহ বিভিন্ন

সরকারি সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন

বলে অভিযোগ শুনে আসছিলাম। এর অবশ্য কিছু

প্রকাশ্য উদাহরণ আমাদের সামনে আগে থেকেই

আছে। যেমন এ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্তত পাঁচটি পাবলিক

বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের

ভর্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু

চাকরির ক্ষেত্রে পর্দার

অন্তরালে কী হচ্ছে না হচ্ছে,

তা অতটা গ্রাহ্যের মধ্যে নিইনি। কিন্তু

সম্প্রতি কয়েক মাস ধরে এ রকম অভিযোগ

আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। গত বুধবার

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনাটি শোনার পর

মাদারাসা থেকে দাখিল-আলিম পাস করেছে এমন

৬ বন্ধু ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ওপরের

চারটি ঘটনা পাওয়া গেছে। দেখা যাচ্ছে, ওপরের

সবকটি ঘটনাই গত ছয় মাসের মধ্যে ঘটেছে।

এছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীগুলোতে মাদরাসা থেকে কোনো পর্যায়ে পাস

করে আসা শিক্ষার্থীদের যে নেয়া বন্ধ

করে দেয়া হচ্ছে, তা অনেক পুরনো অভিযোগ।

আমরা ‘মাদরাসা ছাত্র’ হই কীভাবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলের

এমন ভুক্তভোগী একজন শিক্ষার্থীর প্রশ্ন,

‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স

এবং মাস্টার্স পাস করার পরও কেন

‘মাদরাসা শিক্ষার্থী’ হিসেবে চিহ্নিত হব?’

স্কুলপর্যায়ে কে কোথায় পড়ালেখা করেছে,

সেটা যদি চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে একমাত্র

বিবেচ্য হয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার

মানেটা কী?

উৎসঃ আমার দেশ

বিষয়: বিবিধ

২৩৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File